সাবমেরিনের মতো দেখতে একটি বায়ুনিরোধী আনুভূমিক লৌহ নলের ভেতর একজন জলজ্যান্ত মানুষকে ঘাড়ের নিচ থেকে পা পর্যন্ত আটকে রাখা হয়েছে। যন্ত্রটি আকারে বেশ বড় আর দেখতে খুবই বিদঘুটে। ভাবতে গা শিউরে উঠলেও এটি আসলে জীবন রক্ষাকারী লৌহবর্ম। এই যন্ত্রটির সাহায্যে পোলিওতে আক্রান্ত পল রিচার্ড আলেকজান্ডার তাঁর জীবনের ৭২টি বছর পার করেছেন।
পলের জন্ম ১৯৪৬ সালে, যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের ডালাসে। আর দশজন শিশুর মতোই স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠছিলেন। মাত্র ছয় বছর বয়সে তাঁর জীবনে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসে। গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে পোলিও রোগ মহামারি আকার ধারণ করে।
১৯৫২ সালে হঠাৎই তিনি তাঁর মাথা ও ঘাড়ে ব্যথা অনুভব এবং জ্বরে ভুগতে শুরু করেন। তাঁর মা ভাবেন বৃষ্টিতে ভেজার কারণে হয়তো পল অসুস্থ অনুভব করছেন। পারিবারিক ডাক্তারও পলকে সে সময়ে বাসার বাইরে বের না হওয়ার উপদেশ দেন। কেননা তখন হাসপাতালগুলো পোলিওতে আক্রান্ত রোগীতে পূর্ণ ছিল।
পল সেটি অগ্রাহ্য করলে কয়েক দিনের মধ্যেই সে কথা বলা ও খাবার চাবানোর ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন। মা-বাবা তাঁকে পার্কল্যান্ড হাসপাতালে নিয়ে যান। চিকিৎসকরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিশ্চিত হন পোলিও ভাইরাস পলের স্নায়ুতন্ত্রে আক্রমণ করেছে। তাঁদের পক্ষে আর কিছু করা সম্ভব নয়।
পলের লেখা বইয়ের প্রচ্ছদ
তিনি পলের দেহে ট্র্যাকিওস্টমি সার্জারি করেন। জ্ঞান ফেরার পর পল নিজেকে আবিষ্কার করেন এক বিশালাকার লৌহবর্মের ভেতর। বর্মটির নাম Negative Pressure Ventilator (NPV), যার ভেতরে থেকে নড়াচড়া কিংবা কথা বলাটাও মুশকিল ছিল। তিনি তাঁর আশপাশে লৌহ নলে আটকা পড়া আরো অনেকগুলো শিশুকে দেখতে পান, শুনতে পান তাদের কান্না। সেখানে তারা অপরিষ্কার অবস্থায় দিন কাটাত। একাকিত্বে কাটানো সেই দিনগুলোর কথা স্মরণ করে পল বলেন, ‘প্রতিবার আমি কারো সঙ্গে বন্ধুত্ব করতাম আর সে মারা যেত।’
২৯৫ কেজি ওজনের এনপিভি যন্ত্রটির নিম্নাংশে একটি পাম্প সংযুক্ত। পাম্পটি মূলত অভ্যন্তরীণ বায়ুচাপের ভিত্তিতে চক্রাকারে বাতাসকে প্রবেশ ও বের হতে সাহায্য করে। এই কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাসকে বলা হয় External Negative Pressure Ventilation (ENPV)। ১৮ মাস পর চিকিৎসকরা তাঁকে বাড়ি ফিরে যাওয়ার অনুমতি দিলেও তাঁরা পলকে নিয়ে খুব বেশি আশাবাদী ছিলেন না। শুধু মিসেস সুলিভান নামক একজন ফিজিক্যাল থেরাপিস্ট বাদে। তিনি পলকে জানান, যদি তিনি তিন মিনিটের জন্য লোহার ফুসফুস ছাড়া ‘গ্লসোফ্যারিঞ্জিয়াল শ্বাস’ প্রক্রিয়ায় গলায় বাতাস আটকানো শিখতে পারেন, তবে তাঁকে একটি কুকুরছানা উপহার দেবেন। বছরখানেকের মাথায় পল সেই কুকুরছানাটি উপহার হিসেবে পেয়ে যান। ধীরে ধীরে পল ঘণ্টাখানেক এই যন্ত্রটি ছাড়া শ্বাস-প্রশ্বাস চালিয়ে যাওয়া শিখে ফেলেন, যদিও ঘুমানোর সময় এটি লাগতই।
তবে এত কিছুর মাঝেও পড়ালেখা বন্ধ করেননি পল। ১৯৬৭ সালে ২১ বছর বয়সে প্রথম হোমস্কুলিং করা ছাত্র হিসেবে তিনি ডালাসের উইলিয়াম ওয়ার্থিংটন স্যামুয়েল স্কুল থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন এবং নিজের শ্রেণিতে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। তিনি সাউদার্ন মেথোডিস্ট ইউনিভার্সিটি থেকে স্কলারশিপ পান। পরে ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাসে স্থানান্তরিত হন। ১৯৭৮ সালে সেখান থেকে ব্যাচেলর ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৮৪ সালে তিনি ‘জুরিস ডক্টর’ (আইনশাস্ত্রে প্রফেশনাল ডিগ্রি) ডিগ্রি অর্জন করেন।
শত বাধা পেরিয়ে অদম্য ইচ্ছাশক্তিকে সঙ্গে নিয়ে পল আইনজীবী হয়েছেন, দেশ-বিদেশে ভ্রমণ করেছেন। পাঁচ বছর সময় নিয়ে ২০২০ সালে তিনি তাঁর স্মৃতিকথা ‘থ্রি মিনিটস ফর আ ডগ : মাই লাইফ ইন আ আয়রন লাং’ লেখা সম্পন্ন করেন। কাঠির এক প্রান্তে আঠা লাগিয়ে একটি কলমকে আটকে দেওয়া হতো এবং আরেক প্রান্ত পল দাঁত দিয়ে শক্ত করে চেপে ধরে একেকটি বর্ণ টাইপ করতেন। তাঁকে আধুনিক ভেন্টিলেটর ব্যবহার করতে বলা হলে তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দেন, ‘পুরনো লৌহ ঘোড়া’তেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন। বর্তমানে এ ধরনের এনপিভি যন্ত্র বিলুপ্তপ্রায়। অনেকগুলো বছর স্বল্পক্ষণের জন্য এই যন্ত্র ছাড়া থাকার অভ্যাস চালিয়ে যেতে পারলেও ২০১৯ সালে পল বসন্ত রোগে আক্রান্ত হলে নড়াচড়া করাটা তাঁর জন্য বেদনাদায়ক হয়ে ওঠে। ফলে তিনি সম্পূর্ণরূপে এনপিভির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন।
গেল ১১ মার্চ ৭৮ বছর বয়সে ডালাস হাসপাতালে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন পল। সংগ্রামী ও আত্মবিশ্বাসী পল এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘এ ধরনের জীবন খুবই কঠিন। মানুষ যেগুলো আমার পক্ষে অর্জন করা অসম্ভব বলেছিল, সেসব কিছু অর্জন করতে চেয়েছিলাম। শেষ পর্যন্ত আমি স্বপ্ন ছুঁতে পেরেছি। কারণ, ইচ্ছা থাকলে সবই সম্ভব।’
তথ্যসূত্র : সিবিসি রেডিও, দ্য টেলিগ্রাফ, দ্য সানডে টাইমস
Copyright Banglar Kontho ©2024
Design and developed by Md Sajibul Alom Sajon