শৈশব থেকেই দেখেছি, সংসারে শুধু অভাব আর অভাব! পেটভরে তিন বেলা নুনভাত খাওয়ারও সামর্থ্য ছিল না। আমরা পাঁচ ভাই-বোন। আমি চতুর্থ। বাবা চাষি।
তবে নিজের বলতে ১ শতাংশ জমিও নেই। বসতভিটাটাই কেবল সম্বল। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষায় বাবা আমার ‘গরিবের মধ্যে গরিব’। এতগুলো মুখের তিন বেলা আহার জোগাড় করতেই হিমশিম খেতে হতো তাঁকে।
ধারদেনা শোধ করতে গিয়ে একসময় বসতভিটার অর্ধেকটা পর্যন্ত বিক্রি করে দিতে হয়েছিল! কিশোরগঞ্জের তাড়াইল উপজেলার সুরঙ্গল গ্রামে বাড়ি আমাদের।
অনেক বেদনা সয়ে ডাক্তার হবেন রুমানাচরম অনটনের মধ্যেও আমাদের প্রেরণা জুগিয়েছিলেন মা। তাঁর কাছ থেকে শিখেছি শূন্যহাতে কিভাবে লড়তে হয়। কষ্ট হলেও মা আমাদের পড়াশোনা শিখিয়ে মানুষ করতে চেয়েছেন।
প্রাইমারি স্কুলে উপবৃত্তি পেতাম। সেই টাকা দিয়ে মা হাঁস-মুরগি কিনে পালতেন। সেগুলো বিক্রি করে আমাদের খাতা-কলম কিনে দিতেন। তবে এতজনের পড়াশোনা। দিন দিন খরচ যেন বেড়েই চলেছিল।
বড় আপুর জেএসসি পরীক্ষার সময় ঘরে চাল, ডাল, নুন কিছুই ছিল না। বাসা থেকে অনেক দূরে পরীক্ষার হল। সেখানে যাওয়ার মতো ভাড়াও ছিল না। কারো বাসায় গিয়ে পরীক্ষা দেবেন সে রকম পোশাকও নেই। চাচাতো ফুফু একটা চাদর দিয়েছিলেন। জায়গায় জায়গায় রিপু (সেলাই) করা কামিজ পরে চাদরটা জড়িয়ে আপু ১০ কিলোমিটার হেঁটে চলে গেলেন খালার বাসায়। পরীক্ষাকেন্দ্রের কাছেই তাঁদের বাসা। দূরসম্পর্কের খালা। সেখানেও কাজ করেই থাকতে হয়েছে আপুকে।
তখন দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়তাম। আমাদের আট সদস্যের পরিবার কোনোভাবেই চলছিল না। পড়াশোনা পরে, আগে তো দুমুঠো খেয়ে বাঁচতে হবে। বড় আপু তখন নবম শ্রেণির ছাত্রী। এই বয়সেই সংসারের বোঝা কাঁধে চাপল। বাধ্য হয়ে ঢাকায় গিয়ে গার্মেন্টসে চাকরি নিলেন। মাসে চার হাজার টাকা বেতন। সংসারে বিরাট হাঁ করে আছে অভাব। মেজো আপু ছিলেন ক্লাসের সেরা ছাত্রী। পরের বছর অষ্টম শ্রেণিতে পড়ুয়া সেই আপুুরও ঠিকানা হলো গার্মেন্টস। বাবাও ঢাকার রাস্তায় ইট, বালুর কাজ করতেন। একরত্তি দুই মেয়েকে গার্মেন্টসে চলে যেতে হয়েছে বলে মা শুধু কাঁদতেন।
তখন আমরা তিন ভাই-বোন পড়তাম। কোনো দিন অপচয় করেছি বলে মনে পড়ে না। যতটুকু লাগবে এর চেয়ে কম নিতাম। দিনের আলোয় পড়া শেষ করতাম। প্রাইমারি স্কুল থেকেই সব পরীক্ষায় প্রথম হয়ে আসছিলাম। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় এক কোচিং সেন্টারের পরিচালকের কাছে পারিবারিক অবস্থা শেয়ার করলাম। শুনে সেই মহিউদ্দিন স্যার আমাকে ও ভাইকে অল্প টাকায় পড়ার ব্যবস্থা করে দিলেন।
মায়ের কাছে কখনো টিফিনের টাকা চাইতাম না। তখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি। একদিন মাকে বললাম, স্কুল ড্রেসটা ছিঁড়ে যাচ্ছেতাই অবস্থা। নতুন একটা ড্রেস বানিয়ে দাও না। মা বললেন, ‘কই, জামাটা দে।’ সেটা নিয়ে তিনি হাতে সেলাই করে দিলেন। কিন্তু কাপড় আর সুতার রং ভিন্ন। খুবই বাজে দেখাচ্ছিল। খুব জেদ চাপল। ড্রেস না দিলে ভাত খাব না বলে দুই দিন রাগ করে খাইনি। মা রেগেমেগে আমাকে খুব মারলেন। পরে দেখলাম, তিনি নিজেই কাঁদছেন!
ঈদ এলে সবার চোখেমুখে ঝিলিক খেলা করত, কিন্তু আমাদের ভাঙা ঘরে মন খারাপের উপলক্ষ হয়ে আসত ঈদ! অন্য সময় কষ্ট ভুলে থাকতে পারলেও ঈদের সময় সমবয়সীদের দেখে মন মানতে চাইত না। বছরে একটা দিনও আমাদের ভাগ্যে গরুর মাংস জুটত বলে মনে পড়ে না। একদিন দূরসম্পর্কের এক চাচি এক বাটি মাংস দিয়েছিলেন। তা নিয়ে আমরা তিন ভাই-বোন কাড়াকাড়ি শুরু করলাম। মা রাগ করে তিনজনকেই মারলেন। তিনি সব সময় বোঝাতেন, ‘আমাদের বেঁচে থাকাটাই হয়তো বিধাতার দয়া।’ গরিব হলেও মায়ের আত্মসম্মানবোধ ছিল। কখনো কারো কাছে হাত পাততেন না।
তখন মনে হতো অঙ্কুরেই স্বপ্ন বিনষ্ট হয়ে গেল। পড়াশোনায় মন বসত না। ক্লাসে মনমরা হয়ে বসে থাকতাম। তিন বিভাগের শিক্ষার্থীদের বাংলা ও ইংরেজির ক্লাস একসঙ্গে হতো। একদিন ইংরেজি ক্লাসে স্যার সবার স্বপ্ন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। একে একে সবাই বলতে লাগল তারা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, পাইলট ইত্যাদি হতে চায়। আমার পালা এলে দাঁড়িয়ে হাঁ করে স্যারের দিকে তাকিয়েছিলাম। বুঝতে পারছিলাম না কী বলব। ডাক্তারই যদি না হতে পারলাম, তাহলে তো আমার কোনো স্বপ্নই রইল না! ভাবতেই চোখ ভরে গেল জলে। আমি কিছুই না করতে পারলে পরিবারের কী হবে—ভেবে সব সময় মানসিক চাপে থাকতাম। কারো সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করত না।
এই অবস্থা দেখে মাস দেড়েক পর আত্মীয়-স্বজন ও শিক্ষকরা আমাকে পরে বিজ্ঞানে পড়ার সুযোগ করে দিলেন। এই ঘটনা আমার কাছে মরা গাছে ফুল ফোটার মতো। মা-বাবার মুখে হাসি দেখার জন্য সব সময় স্কুলে টপার হতে চাইতাম। বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় প্রথম হলে তাঁরা খুব খুশি হতেন। শত অভাব-অনটনের পরও তাঁদের খুশি দেখে স্বপ্ন জয়ের আনন্দ পেতাম। এসএসসিতে গোল্ডেন এ প্লাস পেলাম।
২০২০ সালে বড় বোনের বিয়ে হয়ে যায়। দুই বছরের মাথায় মেজো বোনেরও। তখন কিশোরগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজে পড়ছিলাম। দুই বোনের বিয়ের পর আবারও পরিবারে দুর্দশা নেমে আসে। মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে হঠাৎ স্ট্রোক করে দাদিও প্যারালিসিসে আক্রান্ত হন। একদিন বাবা বললেন, ‘আর পড়াশোনা করতে হবে না। যেটুকু পড়েছিস হবে।’ তবে কি এত দিনের পরিশ্রম বিফলে যাবে? কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলাম না। আমার অবস্থা দেখে মাও কাঁদলেন। মনে মনে শপথ নিলাম—যেভাবেই হোক পড়াশোনা চালিয়ে যাব। এইচএসসিতেও এ প্লাস পেয়েছিলাম।
এইচএসসি পরীক্ষার আগে দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের সহায়তার জন্য ঘুড্ডি ফাউন্ডেশন একটা পরীক্ষার আয়োজন করেছিল। সেখানে নির্বাচিত হয়ে বিনা মূল্যে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং ও হোস্টেলে থাকার সুযোগ পেলাম। সেই থেকে ঢাকায় হোস্টেলজীবন। আমার হোস্টেলে থাকা, মেডিক্যাল ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ফরম পূরণ, যাতায়াতসহ সব খরচ দিয়েছিল মানুষ মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন। এর প্রতিষ্ঠাতা চন্দ্র নাথ দাদা মানসিকভাবে সমর্থনও জুগিয়েছেন।
ভর্তি কোচিংয়ের সময় দাদি মারা গেলেন, কিন্তু ভাড়ার টাকা জোগাড় করতে না পেরে বাড়িতে আসতে পারিনি। এর কিছুদিন পর নানি মারা যান। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, নানিকে দেখতে এসে মামাও হার্ট অ্যাটাকে মারা যান। টাকার জন্য তখনো আসতে পারিনি তাঁদের দেখতে। এসব ঘটনায় প্রচণ্ড ভেঙে পড়েছিলাম। তবে শেষে নিজেই নিজেকে সান্ত্বনা দিতাম—ডাক্তার আমাকে হতেই হবে। অবশেষে এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষায় জাতীয় মেধা তালিকায় ২০৫৬তম হয়েছি। খবরটা শুনে মা-বাবা হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন। এখন ভর্তি হয়েছি সিলেটের এমএজি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজে।
গ্রাম থেকে কেউ ডাক্তার হতে পারেনি। দাদির চিকিৎসা করাতে পারিনি টাকার জন্য। যখন কোনো সরকারি হাসপাতালে যেতাম, তখন অসুস্থ-দরিদ্র মানুষকে দেখে কান্না পেত। সেই থেকে ঠিক করেছি, ডাক্তার হলে এই মানুষগুলোর কষ্ট লাঘবের চেষ্টা করব। আমার মতো অসহায় শিক্ষার্থীদেরও পাশে দাঁড়াব। তাদের স্বাবলম্বী হওয়ার পথ দেখাব। কারণ আমি জানি বাস্তবতা কত কঠিন।
Copyright Banglar Kontho ©2024
Design and developed by Md Sajibul Alom Sajon