বইটা হাতে দিয়ে ট্রেনে উঠে পড়লাম
ঢাকা থেকে ট্রেন ছাড়ে দুপুর দেড়টায়। প্রতিবার আগেই পৌঁছানোর চেষ্টা করি স্টেশনে। ঢাকা শহরের জ্যামের ওপর বিশ্বাস নেই। সেদিনও প্রায় দুই ঘণ্টা আগেই পৌঁছলাম।
এমনিতে হাঁটাহাঁটি করছিলাম চত্বরে। মেয়েটা ঠিক পাশেই এসে দাঁড়াল। একটা পরিচিত কণ্ঠ কানে এলো, ‘আপনার ট্রেন কয়টায়?’ আমি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম সেই কণ্ঠস্বরের দিকে, একি নিরুপমা!
কী লিখি তোমায়?ফেসবুকে পরিচয় তার সঙ্গে। আগে কখনো দেখা হয়নি।
তবু সে নিজের গোটা জীবনটা যেন জমা রেখেছে আমার কাছে। জীবনে ঘটে যাওয়া সব কিছু এক এক করে বলেছে এই অচেনা মানুষটার কাছে। আমার কাজ শুধু শুনে যাওয়া। এত দিন তা-ই করে এসেছি।
এভাবে দেখা হয়ে যাবে ভাবতে পারিনি। আমি তার প্রশ্নের উত্তর দিলাম, ‘ঘণ্টা দুয়েক আছে হাতে। যদি আপনার ট্রেন ছেড়ে না যায়।’ সে হাসল, ‘আমার আগে আপনিই ছেড়ে যাবেন, আমার ট্রেন ২টায়।’
নিরুপমাকে শুরু থেকেই পছন্দ করতাম।
বিশেষ করে আমি তার কথার প্রেমে পড়েছিলাম। এ কথা সে জানত কি না, জানি না। তবে আমি বারবার চাইতাম সে আমার হোক, কিন্তু প্রচণ্ড চাপা স্বভাবের হওয়ার কারণে কিছু বলতাম না কখনো। আজ সেই মানুষটা আমার পাশে দাঁড়িয়ে। ছবিতে যতটুকু দেখেছি তার চেয়ে ঢের বেশি সুন্দর সামনাসামনি। আমি আজও কথা হারাচ্ছি বারবার। সে এটাসেটা বলে যাচ্ছে। স্টেশনের এক পাশে একটু নিরিবিলি জায়গায় গিয়ে বসলাম দুজনে।
আমি চোরাচোখে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিলাম তাকে। সে কিভাবে কথা বলে। হাসে। তাকায়। সে ভালো গান গাইত। মাঝেমাঝে আবৃত্তিও করত। এরই মধ্যে একটা ট্রেন এসে থামল। স্টেশন মানুষে ভরে গেল। চারদিকে একটা শোরগোল। মিনিট পাঁচেক পর আবার সেই নীরবতা। সে বলল, ‘আপনার আর আমার মাঝে পার্থক্য কী, জানেন? এই যে একটু আগে শোরগোল, চঞ্চলতা, এটা হলাম আমি। আর এখন যে নীরবতাটা, সে আপনি।’ মাথা নাড়িয়ে সায় দিলাম।
সময় যেন দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল আরেকটু লম্বা হোক। যে দুই ঘণ্টা আমার কাছে অনেক সময় ছিল, সেটা তখন খুব কম মনে হচ্ছিল। দেখতে দেখতে ঘড়ির কাঁটায় তখন ১টা ২০। দুজনে ট্রেনের দিকে পা বাড়ালাম।
যাওয়ার আগে এক অসাধ্য সাধন করে বসলাম। ব্যাগে জীবনানন্দের একটা বই ছিল। ট্রেনে বই পড়ার অভ্যাস অনেক আগে থেকেই। তার হাতে বইটা দিয়ে বললাম—প্রথম দেখার উপহার। সে ব্যাগ থেকে কলম বের করে বলল, ‘ধন্যবাদ। তবে কিছু লিখে দিন।’ বইয়ের ফাঁকা পাতাটায় হাতে আঁকা কাল্পনিক ছবিটার সঙ্গে একবার বাস্তবিক মানুষটার মিল খুঁজি। তারপর হাঁটতে হাঁটতে কাঁপা হাতে কলম ঘোরালাম। ‘ভালোবাসি’ লিখতে ইচ্ছা করলেও সে কথা কি আর লেখা যায় এত সহজে! ততক্ষণে আমার ট্রেনের হুইসেল বাজছে। তাড়াহুড়া করে বইটা হাতে দিয়ে ট্রেনে উঠে পড়লাম।
সৌরভ আহমেদ
নেত্রকোনা
Copyright Banglar Kontho ©2024
Design and developed by Md Sajibul Alom Sajon