বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ থাকলেও প্রায় অর্ধশত বিশ্ববিদ্যালয়ে গঠিত হয়েছে রাজনৈতিক দলের ছাত্রসংগঠনের কমিটি। নামসর্বস্ব এসব কমিটির ক্যাম্পাসে কোনো কার্যক্রম নেই। শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায় বা স্বার্থ রক্ষায়ও তাদের কোনো ভূমিকা নেই। এর পরও বাকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এমন রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠনের কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া চলছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এসব কমিটির নেতাকর্মীরা জাতীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়ে থাকেন, যাতে পরবর্তী জীবনে রাজনীতিতে সক্রিয় থেকে কাঙ্ক্ষিত পদ-পদবি নেওয়া যায়।
সম্মিলিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে দেশে ১০৮টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা কার্যক্রম চলছে। এর মধ্যে ৪৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ে গঠিত হয়েছে রাজনৈতিক দলের ছাত্রসংগঠনের কমিটি। বাংলাদেশ ছাত্রলীগের অনুমোদিত ‘সম্মিলিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ’ থেকে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কোথাও পূর্ণাঙ্গ, কোথাওবা আংশিক কমিটি দেওয়া হয়েছে।
শিক্ষার্থীদের রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে ৫১, ৭১ বা ১০১ সদস্যবিশিষ্ট এসব কমিটির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। তবে ছাত্রলীগের কমিটি থাকলেও অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের ছাত্রসংগঠনের কমিটি এখনো নেই। এ ছাড়া সাধারণ শিক্ষার্থীদের অধিকার রক্ষায় বেসরকারি কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই নির্বাচিত ছাত্রসংসদ।
সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাধারণ শিক্ষার্থীরা বলছেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের এসব কমিটি থাকলেও ক্যাম্পাস ও তার বাইরে দৃশ্যত তাদের কোনো কার্যক্রম নেই।
কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এসব সংগঠনের অস্তিত্ব সম্পর্কেও জানেন না।
নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ষষ্ঠ সেমিস্টারের শিক্ষার্থী ওয়ালি উল্লাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘২০২২ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের কমিটি গঠন করা হয়। ভেবেছিলাম এতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো অথবা মন্দ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হবে। অথচ এখনো তাদের কোনো কার্যক্রম নেই। কমিটিতে নেতা কারা আছেন, তাও জানা নেই।
রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড না থাকায় ক্যাম্পাসের বাইরেও এসব সংগঠনের কোনো প্রভাব নেই।’
ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড ইউনিভার্সিটির একাধিক শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এখানে কোনো ধরনের ছাত্রসংগঠন আছে বলে জানা নেই। ক্যাম্পাসে রাজনীতির কোনো সুযোগ নেই। এখনো কোনো ছাত্রসংগঠনের কার্যক্রম চোখে পড়েনি।’
ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের শিক্ষার্থী-কর্মকর্তারা জানান, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় প্রতিদিন অ্যাসাইনমেন্ট ও হাজিরার ওপর নম্বরসহ পড়াশোনার এত চাপ থাকে যে সংগঠন করার সময় থাকে না। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিস্টার ফি পাবলিকের তুলনায় বেশি হওয়ায় পরিবার থেকেও শিক্ষার্থীদের ওপর বাড়তি চাপ থাকে। ফলে এখানে শিক্ষার্থীদের রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার সুযোগ কম।
সম্মিলিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ সভাপতি রবিউল ইসলাম সজিব কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের নিয়েই ছাত্ররাজনীতি। অধিকার আদায়ে শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ানো ছাত্রসংগঠনগুলোর কাজ। ছাত্ররাজনীতি গণতান্ত্রিক চর্চা এবং নাগরিক অধিকার। তবে যেকোনো কার্যক্রম নতুন করে শুরু হলে অনেক প্রতিবন্ধকতা থাকে। ক্যাম্পাসে রাজনীতি চর্চার সুযোগ না থাকলেও তাঁরা জাতীয় কর্মসূচিগুলোতে অংশগ্রহণ করেন। এখান থেকে অনেকেই ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে যুক্ত হয়েছেন, কেউবা জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি বা উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান হয়েছেন। ছাত্ররাজনীতির চর্চা থাকার কারণে এটা হয়েছে। আশা করি, আগামী দিনে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মতো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও ছাত্ররাজনীতি জোরালো হবে।’
এ বিষয়ে বাংলাদেশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির চেয়ারম্যান শেখ কবির হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্ররাজনীতির নামে যেসব কর্মকাণ্ড চলছে, তা আমরা সবাই দেখতে পাই। ক্যাম্পাসে রাজনীতি থাকলেই মারামারি-কাটাকাটি লাগবে। এমন পরিস্থিতি এড়াতে ক্যাম্পাসে আমরা রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছি। এ ছাড়া ছাত্রসংসদ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রযোজ্য। সেখানে সরকারি অর্থায়নে ভবন থেকে শুরু করে শিক্ষার্থীদের জন্য বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড হয়ে থাকে। ফলে সেশনজট থেকে শুরু করে নানা জটিলতাও থাকে। এ জন্য শিক্ষার্থীদের অনেক চাহিদাও থাকে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এসব সমস্যা নেই।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, অতীতের মতো বর্তমানে ছাত্ররাজনীতির জন্য শিক্ষার্থীদের পছন্দের স্থান পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে রাজনীতির চর্চা করার সুযোগ কম থাকায় অনেক শিক্ষার্থী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে পছন্দ করেন। এসব শিক্ষার্থীর মধ্যে অনেকে পরিবারের বিপক্ষে গিয়েও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে চান।
ছাত্ররাজনীতির মাধ্যমে জাতীয় রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) ভর্তির অপেক্ষায় আছেন গোলাম মোরশেদ (ছদ্ম নাম)। সম্প্রতি বি-ইউনিট থেকে পরীক্ষা দিয়ে ভর্তির মেধা তালিকায় স্থান করে নিয়েছেন তিনি।
গোলাম মোরশেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ছোটবেলা থেকে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকার প্রবল ইচ্ছা। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ট্রাস্টের অধীনে থাকায় সেখানে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত হওয়ার সুযোগ কম। এসব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে আসার সম্ভাবনাও নেই। ঢাবি শুধু একটি বিশ্ববিদ্যালয় না, আমি মনে করি, শিক্ষায় নেতৃত্বের পাশাপাশি রাজনীতি ও সমাজনীতিতেও এই বিশ্ববিদ্যালয় নেতৃত্ব দেয়। বিশ্ববিদ্যালয়টির ছাত্ররাজনীতির গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস রয়েছে।
ছাত্রনেতাদের দাবি, রাজনীতি করতে গেলে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে কখনো একটি সেমিস্টার ড্রপ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সেমিস্টার ফি ব্যয়বহুল। এ ছাড়া ট্রাস্টি বোর্ডের অধীনে পরিচালিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ব্যক্তি ক্ষমতা প্রাধান্য পায়। এসব কারণে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যাম্পাসের ভেতরে ও বাইরে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকে অগ্রহণযোগ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। রাজনীতিতে সম্পৃক্ততার প্রমাণ পেলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নানা পদক্ষেপ নেয়। কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময় শিক্ষার্থীদের সংগঠন না করার বিষয়ে লিখিত নিয়ে থাকে। এমন প্রতিকূলতার কারণে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ছাত্ররাজনীতিতে পিছিয়ে থাকেন।
রাজনীতি বিশ্লেষক অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘স্বাধীনতার আগে আমাদের ছাত্ররাজনীতির যে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস ছিল, কালের বিবর্তনে তা ধুলায় মিশেছে। বিশেষ করে স্বাধীনতার পর থেকে রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠনগুলোর উল্লেখযোগ্য কোনো ভূমিকা নেই। শিক্ষার্থীদের প্রথম কাজ পড়াশোনা করা। এরপর তারা ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন অধিকার আদায়ে সোচ্চার হবে। দেশের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলোর সমালোচনা করবে। তা না করে তারা টেন্ডারবাজি, চাঁদা আদায়, ক্যাম্পাস দখল ও প্রভাব বিস্তারের জন্য অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করছে।
বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির দপ্তর সম্পাদক মেফতাহুল ইসলাম পান্থ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সক্রিয়ভাবে ছাত্ররাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার সুযোগ কম। তবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাজনীতিতে কোনো বৈষম্য নেই। রাজনৈতিক পরিচয়ে টেন্ডারবাজি বা চাঁদাবাজি হয় না, এ কথা বলা যাবে না। দু-একজন এমন কাজ করলেও সংগঠনের পক্ষ থেকে আমরা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করি। ছাত্রলীগ এমন রাজনীতি চায় না। ছাত্রসংগঠনের মাধ্যমে আমরা শিক্ষার্থীদের অধিকার নিয়ে কথা বলি। জাতীয় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলো নিয়ে আন্দোলন করি।’
Copyright Banglar Kontho ©2024
Design and developed by Md Sajibul Alom Sajon