বাংলাদেশ ছাত্রলীগ গতকাল রবিবার প্রকাশ্যে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ক্যাম্পাসে প্রবেশ করেছে। এর আগে তারা বুয়েট ক্যাম্পাসে পুনরায় ছাত্ররাজনীতি চালুর দাবিতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে প্রতিবাদ সমাবেশ করে। এদিকে সব রাজনৈতিক ও নিষিদ্ধ সংগঠন থেকে বুয়েটকে মুক্ত রাখার শপথ নিয়েছেন বুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
বুয়েট ক্যাম্পাসে গত বুধবার মধ্যরাতে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের প্রবেশের অভিযোগ এনেছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
এর প্রতিবাদে গত শুক্রবার থেকে বিক্ষোভ কর্মসূচিসহ একাডেমিক কার্যক্রম বর্জন করে ছাত্ররাজনীতিবিহীন ক্যাম্পাসের দাবিতে আন্দোলন করছেন তাঁরা।
এর ধারাবাহিকতায় গতকাল বুয়েটের ২০ ব্যাচের টার্ম ফাইনাল পরীক্ষায় দুজন বাদে সব শিক্ষার্থী স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকেন। বিকেল সাড়ে ৫টায় ড. এম এ রশীদ প্রশাসনিক ভবনের সামনে এক সংবাদ সম্মেলনে তাঁরা এমন তথ্য জানান।
নিরাপত্তাজনিত তীব্র শঙ্কা থাকায় গতকাল সকাল ৭টায় পূর্বঘোষিত অবস্থান কর্মসূচি পালন করা হয়নি বলে সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষার্থীরা বলেন, ক্যাম্পাসের আশপাশের সব এলাকায় গত শনিবার রাত থেকে ক্রমাগত মাইকিং করা হয়, শিক্ষার্থীদের ফোনকলে হুমকি-ধমকি দেওয়া হয়।
এ ছাড়া সোশ্যাল মিডিয়ায় নানা রকম গুজব ছড়িয়ে, বুয়েট শিক্ষার্থীদের মিথ্যা ট্যাগ দিয়ে, শিক্ষার্থীদের ছবিসহ নাম-পরিচয় পোস্ট করে তাঁদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তার গুরুতর বিঘ্ন ঘটানো হয়। এমন পরিস্থিতিতে বুয়েট ক্যাম্পাস এবং আশপাশের এলাকা শিক্ষার্থীদের জন্য অনিরাপদ হয়ে পড়েছে। এমনকি বুয়েট ক্যাম্পাসের বাইরেও শিক্ষার্থীরা তাঁদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত।
নিরাপত্তাজনিত এসব কারণে শিক্ষার্থীদের আজ (রবিবার) ক্যাম্পাসে অবস্থান না নেওয়া মানে এই নয় যে বুয়েট শিক্ষার্থীরা তাঁদের ছাত্ররাজনীতিবিহীন ক্যাম্পাসের দাবি থেকে সরে এসেছেন।
এ দাবি বুয়েটের সব ব্যাচের সব শিক্ষার্থীর।
হিযবুত তাহরীর ও ইসলামী ছাত্র শিবিরের কার্যক্রম চলমান বুয়েট ক্যাম্পাসে এমন বক্তব্যের বিষয়ে সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষার্থীরা বলেন, ‘আমাদের ইনস্টিটিউশনাল মেইলে হিযবুত তাহরীর সংক্রান্ত মেইল দেখার পর অনতিবিলম্বে সর্বপ্রথম ডিএসডাব্লিউ স্যারকে ভার্চুয়ালি এই মর্মে ইনফরম করা হয়, আমাদের আন্দোলনরত এই শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকেই। এ ব্যাপারে ডিএসডাব্লিউ স্যারের কাছে যথাযথ পদক্ষেপ আহ্বান করা হয়। পরে ভিসি স্যারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এ ব্যাপারে অগ্রগতি জানতে চাওয়া হলে স্যার জানান, এ ব্যাপারে বুয়েট তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। এর আগেও বিগত ব্যাচের শিক্ষার্থীদের এদের বিরুদ্ধে পুলিশে অবহিত করার রেকর্ড আছে।
’
শিক্ষার্থীরা বলেন, ‘যেসব শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে শিবিরের কার্যক্রমে যুক্ত থাকার অভিযোগ আসছে, তাদের ঘটনাটি বুয়েটের বাইরে হয়েছে এবং এখন পর্যন্ত এই ঘটনার বিষয়ে আমাদের কাছে সুস্পষ্ট কোনো প্রমাণ নেই। তবে অভিযোগ আসার সঙ্গে সঙ্গে আমরা তাদের সম্পর্কে বিশ্ববিদ্যালয়ের তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়ার লিখিতভাবে আহ্বান জানাই। এটি আমাদের পূর্বের একটি আন্দোলনের অন্যতম দাবি ছিল। মাননীয় আদালতে বর্তমানে এই মামলাটি বিচারাধীন আছে এবং এই বিচারপ্রক্রিয়ার রায় সাপেক্ষে যদি এ রকম কোনো শিক্ষার্থীর শিবিরসংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়া যায়, আমরা তাত্ক্ষণিকভাবে তাদের বহিষ্কারের দাবি জানাব।’
চলমান আন্দোলন নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ‘দফায় দফায় প্রতিবাদ জানানোর পরও ছাত্রলীগ সংশ্লিষ্টরা বুয়েটের শিক্ষার্থীদের অরাজনৈতিক ক্যাম্পাসের ইচ্ছাকে সম্মান না করে ক্যাম্পাসে পুনরায় ছাত্ররাজনীতি ফিরিয়ে আনার নানা রকম উদ্যোগ নিয়েছে। ক্রমাগত অসন্তোষ এখন তীব্র আন্দোলনে রূপ নিয়েছে শুধু একটি নিরাপদ ক্যাম্পাস চাওয়ার দাবি থেকেই। আমরা শপথ করছি, সব রাজনৈতিক ও নিষিদ্ধ সংগঠন থেকে বুয়েটকে মুক্ত রাখার। আমরা আবরার ফাহাদ ভাইয়ের রক্ত বৃথা যেতে দেব না।’
বুয়েট ক্যাম্পাস রাজনীতিমুক্ত থাকা, অপশক্তির কবল থেকে মুক্ত থাকা এবং নিরাপত্তার নিশ্চয়তা শিক্ষার্থীরা পেলে সব ব্যাচের শিক্ষার্থীরা অবিলম্বে একাডেমিক কার্যক্রমে ফেরত যাবে বলে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়। এ ছাড়া বর্জন করা পরীক্ষাগুলো রিশিডিউল করার আবেদন জানানো হয়েছে বলে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়।
এদিকে বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি চালুর দাবিতে ও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সদস্য ইমতিয়াজ হোসেনের সিট বাতিল করায় প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। সমাবেশ শেষে বুয়েট ক্যাম্পাসে যান ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এ সময় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতারা বুয়েট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
প্রতিবাদ সমাবেশে সভাপতির বক্তব্যে সাদ্দাম হোসেন বলেন, ‘বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে যেকোনো জায়গায় প্রবেশের অধিকার আমার রয়েছে। নিরবচ্ছিন্ন সময় কাটানোর জন্য আমি যাই, সংবিধান প্রদত্ত অধিকার হিসেবে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার অধিকার আমার রয়েছে। কাদের কাছে পারমিশন নিতে হবে! যাদের সংবিধান অধিকার দিয়েছে, তাদের মামাবাড়ির আবদারের মতো ঠুনকো বানিয়ে দেবেন? আমরা মেনে নেব বলে যাঁরা আশা করছেন, তাঁরা বোকার স্বর্গে বসবাস করছেন। একটি নন-ইস্যুকে ইস্যু বানানো হয়েছে, পৃথিবীর যেকোনো জায়গায় আমার প্রবেশের অধিকার রয়েছে। আমাদের প্রবেশের জায়গা সংকুচিত করে অন্ধকারের চাষাবাদ শুরু করেছেন। ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ হলেও নিষিদ্ধ রাজনীতির নমুনা আমরা ক্ষণে ক্ষণে দেখতে পাচ্ছি।’
সাদ্দাম বলেন, বুয়েটের সিদ্ধান্ত অন্যায্য, অসাংবিধানিক এবং নাগরিক অধিকারবিরোধী। বুয়েটে রাজনীতি নিষিদ্ধের এই নাটক বন্ধ করতে হবে। বুয়েট যে নিয়ম চালু করেছে, তা কালাকানুন। অনতিবিলম্বে বুয়েটে নিয়মতান্ত্রিক ছাত্ররাজনীতি চালু করতে হবে। ইমতিয়াজ রাব্বির সিট ফিরিয়ে তাকে হলে বরণ করে নিতে হবে। অবিলম্বে ছাত্র সংসদ নির্বাচন দিতে হবে।
প্রতিবাদ সমাবেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ছাত্রলীগসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ইউনিট ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা সমবেত হন।
শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা চাইলে বুয়েটে আবার ছাত্ররাজনীতি চালু করা যেতে পারে বলে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য ড. সত্য প্রসাদ মজুমদার। গতকাল দুপুরে সাংবাদিকদের উপাচার্য বলেন, ‘পূর্বে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা যদি বুয়েটে রাজনীতি বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন, তবে সেই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে হলে তাঁদেরই আবার উদ্যোগী হতে হবে। এ জন্য রাজনীতি শিখতে হবে। তাঁরা যদি চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নেন, তখন হয়তো রাজনীতি চালু হতে পারে।’
মাস্টার্সের পরীক্ষা হয়েছে
শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে একাডেমিক কার্যক্রম বর্জন কর্মসূচি থাকলেও বুয়েটের ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিল্ডিংয়ের ২০১, ২০২, ২০৩ নম্বর কক্ষে মাস্টার্সের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ফাইনাল পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের অংশ নিতে দেখা যায়। গতকাল বিকেলে সরেজমিনে গিয়ে কক্ষগুলোতে পরীক্ষা চলতে দেখা যায়। ২০১ নম্বর কক্ষে পরীক্ষকের দায়িত্বে থাকা একজন শিক্ষক বলেন, শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি শতভাগ।
বুয়েট জঙ্গিদের কারখানা কি না তদন্ত হচ্ছে : কাদের
বুয়েটকে অপরাজনীতির কারখানা বানানো হচ্ছে কি না, তা সরকার খতিয়ে দেখছে বলে মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। গতকাল সকালে রাজধানীর তেজগাঁওয়ে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয় ভবনে চট্টগ্রাম বিভাগের বিভিন্ন পর্যায়ের আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময়সভায় তিনি এসব কথা বলেন।
তিনি বলেন, ‘বুয়েটের ঘটনার তদন্ত চলছে। আমরা খতিয়ে দেখছি। সেখানে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করার নামে বুয়েটকে একটা অপরাজনীতি জঙ্গিবাদের কারখানায় পরিণত করা হবে। এটা যাতে না হয়, আমরা তা তদন্ত করে দেখছি। এ রকম কিছু পাওয়া গেলে সরকারকে অ্যাকশনে যেতে হবে।’
নজর রাখছে ডিবি
বুয়েটে ছাত্র আন্দোলনের নামে নিষিদ্ধ কোনো সংগঠনের তত্পরতা রয়েছে কি না, তা পর্যবেক্ষণ করছে মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)। গতকাল দুপুরে রাজধানীর মিন্টো রোডের নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন ডিবি প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিবি প্রধান বলেন, ‘এ ধরনের অভিযোগ আগেও পেয়েছি আমরা। এর আগেও বুয়েট থেকে জঙ্গি সংগঠনের সদস্য গ্রেপ্তার হয়েছে। সেখানে ছাত্র শিবিরের কর্মকাণ্ড নিয়েও তথ্য পাওয়া গেছে। তবে আমরা সব বিষয় পর্যবেক্ষণ করছি।’
৩৪ শিক্ষার্থীকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কারের দাবি
সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওরে গত বছরের জুলাইয়ে গ্রেপ্তার বুয়েটের ৩৪ শিক্ষার্থীকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কারের দাবি জানিয়েছে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ। এ জন্য ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়েছেন সংগঠনের নেতারা। গতকাল বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশে এই দাবি জানানো হয়।
Copyright Banglar Kontho ©2024
Design and developed by Md Sajibul Alom Sajon