বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন, ষাটের দশকের উত্তাল ছাত্র রাজনীতি, আইয়ুব-মোনায়েম বিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়েই বাবু সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের রাজনীতিতে পদার্পণ। ষাটের দশকে ছয় দফার আন্দোলন, শিক্ষার আন্দোলন, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান,৭০ এর নির্বাচন, ৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে সব স্থানেই ছিল সুরঞ্জিতের সরব উপস্থিতি। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বাংলাদেশের রাজনীতিতে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আলো ছড়িয়েছেন। একজন আলো ছড়ানো রাজনীতিবিদের বর্তমানে আমাদের দেশে খুবই অভাব। রাজনীতিতে যে শিষ্টতা,পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, আদর্শের প্রতি অবিচল নিষ্ঠা তা আমাদেরকে দেখিয়ে গেছেন বাবু সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত।
সুনামগঞ্জ জেলার দিরাই উপজেলার আনোয়ারপুর গ্রামে ১৯৩৯ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত।তাঁর পিতার নাম দেবেন্দ্র নাথ গুপ্ত, মাতার নাম সুমতিবালা সেনগুপ্ত।দিরাই মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় হতে ৫ম শ্রেণি ও দিরাই উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এস.এস.সি এবং সিলেট এম.সি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে সম্মান ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। পরে ঢাকা সেন্ট্রাল “ল” কলেজ থেকে এল.এল.বি ডিগ্রি গ্রহণ করেন।তিনি সুপ্রীম কোর্ট বার কাউন্সিলের সদস্যও ছিলেন।
ষাটের দশকের মাঝামাঝি বাবু সেনগুপ্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিজ এলাকায় ফিরে গেলে জনগন তাকে সাদরে গ্রহণ করে নেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল ছাত্র ইউনিয়ন কমিটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেও তাঁর প্রধান পরিচয় ছিল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সংগঠক হিসেবে। তিনি চমৎকার অভিনয় করতেন। রামেন্দু মজুমদার,আব্দুল্লাহ আল-মামুন,ফেরদৌসী মজুমদার তাদের সঙ্গে কাজ করতেন। তাঁর লেখা একাধিক নাটক সে সময় প্রশংসিত হয়েছে। অসাধারণ মেধার অধিকারী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শামসুর রাহমান, সুকান্ত, জীবনানন্দ দাশের কবিতা বক্তৃতার ফাঁকে ফাঁকে উধৃতি দিতেন এবং একবার চোখ বুলালেই মুখস্থ করতে পারতেন। একজন সৃজনশীল রাজনীতিবিদ হয়ে সংস্কৃতি ও ভাবুক মনের সাহিত্য রসবোধ ছিল লক্ষ্যণীয়।
মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি একজন সাব-সেক্টর কমান্ডার ছিলেন।স্বাধীন বাংলাদেশের গণপরিষদের একমাত্র বিরোধীদলীয় নেতা ছিলেন তিনি। সংবিধান প্রণেতাদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। জাতীয় সংসদে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সুরঞ্জিতের বক্তব্য মনোযোগ দিয়ে শুনতেন। সংবিধান বিলের বিভিন্ন অনুচ্ছেদ নিয়ে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বেশ দীর্ঘ ও তীব্র বক্তৃতা দিতেন। বঙ্গবন্ধু একদিন অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে জিজ্ঞেস করলেন সুরঞ্জিতের বক্তব্য শুনছেন কি না। উত্তরে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বললেন মাঝে মাঝে শুনি। বঙ্গবন্ধু হেসে বললেন, ‘১৯৫৬ সালে পাকিস্তান গণপরিষদে কনস্টিটিউশন নিয়ে আমি যেসব কথা বলেছি, সেসব কথাই এখন সুরঞ্জিত আমাকে শোনাচ্ছে। তখনকার হাউজের ডিবেট পড়ে দেখো।
গণপরিষদে সংবিধান-বিল উত্থাপিত হলে সংশোধনীর প্রস্তাব আসে ১৩৪টি, তার মধ্যে আওয়ামী লীগ-দলীয় সাংসদদের ৬০টি এবং সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের একটি সংশোধনী গৃহীত হয়। ৭০ অনুচ্ছেদ শেষ পর্যন্ত সংশোধিত হয়। বাবু সেনগুপ্তের গৃহীত তাৎপর্যপূর্ণ প্রস্তাব ছিল, বাংলাদেশের সকল উপজাতীয় জনগণের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক তথা সামগ্রিক বিকাশের উপযুক্ত ব্যবস্থাগ্রহণ এবং তফসিলি সম্প্রদায়ের অধিকার সংরক্ষণের জন্যে একটি নতুন অনুচ্ছেদ যোগ করা।
আট বার সংসদ নির্বাচিত হয়ে ৩০ বছরের বেশি সময় কাজ করেছেন সংসদে।সংসদ সংবিধান, কার্যপ্রণালী বিধি বিষয়ে গত ৩ দশকে তাঁর মতো বিজ্ঞ আর দ্বিতীয় কেউ আছেন বলে মনে হয় না। তাঁর সবচেয়ে বড় গুন ছিল তিনি সবসময় পড়াশোনায় মগ্ন থাকতেন। সংসদের জটিল কিংবা সিরিয়াস কোন বিষয় হলে স্পিকার তাঁকে খুজতেন এবং তিনি পরামর্শ দিতেন। সংসদে কোন আইন এলে অনেক সময় পরীক্ষা-নিরীক্ষার দায়িত্ব দেয়া হতো তাঁকে। তাঁর কথায় কোন লুকোচাপা থাকত না। যা বুঝতেন পরিষ্কার করে বলতেন এবং উচ্চারণ করতেন। কোন ভয় বা সমীহ করার স্বভাব ছিল না তাঁর। সংসদীয় রাজনীতিতে তাঁর মতো বিজ্ঞ-দক্ষ, জানা-শোনা নেতা পাওয়া এখন বিরল। নতুন সংসদ সদস্যদের জন্য দুই দিনের যে কর্মশালা হয় সেটিতে তিনি প্রধান প্রশিক্ষকের ভূমিকায় থাকতেন। তাই তাঁকে বলা হয় সংসদের কবি।
বাবু সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত কোনদিন অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি থেকে লক্ষচ্যুত হননি। জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ছিলেন আপোষহীন, মুক্তিযুদ্ধের সুমহান চেতনায় রাজনীতি করেছেন, সাধারণ মানুষের পক্ষে লড়াই করেছেন। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ছিলেন বীর সাহসী হার না মানা রাজনীতিবিদ। বাংলাদেশের সংসদীয় গণতন্ত্রে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত আজীবন অমর হয়ে থাকবেন।
সুব্রত তালুকদার।
সম্পাদক ও প্রকাশক
দৈনিক বাংলার কন্ঠ।
Copyright Banglar Kontho ©2024
Design and developed by Md Sajibul Alom Sajon