অনেকদিন পরে গ্রামের বাড়ি
আমাদের গ্রামের বাড়িতে যেতে নীলগঞ্জে ট্রেন থেকে নেমে এক মাইলের মত খোয়া—ওঠা রাস্তায় হাঁটতে হয়। আমার চেনা রাস্তা। তবুও এইরকমভাবে একা একা এখানে কখনও হাঁটিনি। রাস্তার একপাশে নরসুন্দা নদী, সারা শীত জলহারা থেকে এখন নতুন ঢল ঢল জল পেয়ে নদী ডগমগ করছে। কিশোরগঞ্জের বুক চিড়ে করিমগঞ্জের কাছে দুই ভাগ হয়েছে নরসুন্দা, একভাগ বাঁয়ে মোড় নিয়ে এই নীলগঞ্জে এসেছে। দেখি নদীর কুলকুল পানিতে ছাড়া ছাড়া কচুরিপানা ভেসে যাচ্ছে। অন্যপাশে লাগোয়া সব ঘরবাড়ি। বৈঠক ঘরের সামনে একফালি আঙিনা, একপাশে খড়ের স্তুপ, অন্যপাশে খঁুটিতে গরু বাঁধা। কিছু অনাথ কলাগাছ অনাদরে বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে আছে, বাশঁঝাড়ের পাশে অতসী ফুলের গাছ হলুদ ফুল নিয়ে হাসছে। প্রতিটি বাড়ি প্রায় একইরকম। মাঝে মাঝে দুই একটি বাড়ির সামনে দেখি টলমল পানি ভরা পুকুর। পুকুরের পানিতে ছায়া পড়েছে, তাই শান্ত ও নিবিড়। নিবিষ্ট মনে হেঁটে যাচ্ছে ট্রেন—নামা মানুষ, আমিও তাদের অনুসরণ করে পৌঁছে যাই নীলগঞ্জ বাজারে। বাজারের পুব পাশে নৌকার ঘাট। ভিটা থেকে বেশ নীচে, আমি নেমে যাই। আমি সমস্যায় পড়ি, নৌকা নিয়ে আমি মাঝিকে কোন ঘাটে যেতে বলব! আব্বা সাধারণত নৌকায় ঘণ্টা দুয়েক যাওয়ার পরে, দরগাহ ঘাট বলে এক জায়গায় নৌকা থেকে নেমে, কারো বাড়ির ভেতর দিয়ে, কিছু ক্ষেতের আইল ধরে কোনাকুনি বাড়ি চলে যান, কিন্তু, আমি আব্বার এই শর্টকাট চিনিনা। তারচে’ বরং করমশি বাজারে যাই, দরগাহ ঘাট থেকে কিছু দূরে; করমশি থেকে বাড়ির পথ আমার চেনা। ভাবছি, এমন সময় দেখি, একজন মাঝি আমার দিকে এগিয়ে এল, আমার নামও বলল। তারপর নিজের নাম বলল, ‘আমি ছোবহান, বায়ু, আমারে চিন্তায় পারতাছনা? আমি তোমরার বাড়ির কাছেই থাহি। উড, উড, নৌকায় উড’। আমি যেন চেনা লোক পেয়ে বেঁচে যাই। আমার এই নৌকার পথটুকু অনেক প্রিয়। ছোটবেলা থেকেই আব্বার সাথে বছরে বছরে এসেছি। গভীর খাদের নদী, সরু কিন্তু পানি থাকে এখানটায় সারা বছর। আব্বার যেন সব চেনা, নদীর বাঁক, নদীর মানুষ, সব। খেপ—জাল ফেলে জেলে মাছ তুলছে, পাশ দিয়ে যেতে যেতে মাঝিকে আব্বা বলেন, ‘এই, এই নৌকা থামা’, তারপর জেলেকে উঁচুস্বরে ডেকে বলেন, ‘কি মাছ ওঠল?’ জেলে মাছ দেখায়, আব্বা বলেন ‘দেও, সব কয়টাই দেও’, তারপর ছোবহান মাঝিকে বলেন, ‘নে’ নে’, সব কয়টা লইয়া ল’।
আমরা করমশি বাজারের ঘাটে আসি। তখন দুপুর হয় হয়। ছোবহান ভাই বলে, একলা একলা যাইতার বা’! আমি বলি পারব। আমি বাজারের ভেতর দিয়ে অন্য পাশের পথ ধরি। আরেক মাইল দূরে আমাদের গ্রামের বাড়ি। অল্প একটু দূরে গিয়েই একটা মাঠ, মাঠের একপাশে করমশি প্রাইমারি স্কুল, অন্যদিকে পাকা মসজিদ। মসজিদের পাশ দিয়ে নেমে গেছে সরু ক্ষেতের আইল। দূরে দেখি গাছ গাছালি ভরা আমাদের গ্রাম। আমি সেইদিকে চেয়ে চেয়ে ক্ষেতের আইলে আইলে পা রেখে বাড়ির রাস্তা চিনে নেই। বাড়ির পেছনেই খাল, খালের ওপর বাঁশের সাঁকো, সাঁকো দিয়ে বাড়ির পাড়ে আসি।
বড় চাচা বাড়িতে। আব্বারা চার ভাই। আব্বা যখন ক্লাস সেভেনে পড়েন, তখন দাদা মারা যান। আব্বার বড় দুইভাই, তাঁরা ঠিক করলেন, আব্বার মাথা ভাল, আব্বাকে তাঁরা পড়াবেন। বড় চাচা মাতব্বর মানুষ, তিনি ব্রিটিশ আমল থেকে ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট ছিলেন, এখন তিনি আইয়ুব খান আসার পরে হয়েছেন বেসিক ডেমোক্রেসি সিস্টেমের ইউনিয়ন—চেয়ারম্যান। চাচার অনেক সুনাম গ্রামে, প্রতিপত্তিও। তাঁকে ছাড়া এ গ্রামে কোন বিচার বসেনা। তাঁর কাছে ন্যায় বিচারের অন্যথা নাই। এসব দাদুর কাছে শোনা। দাদু বলেন, ‘এই ভুঁইয়া বাড়ির অনেক সুনাম’। রাতের বেলা তাঁর ঘরে শুয়ে শুয়ে দাদুর মুখে অনেক শিলুক শুনি, আমি শুনে শুনে বিভোর হই। দাদু বলেন, ‘তর দাদারা, এই দ্যাখ এই—ই এইডার নিচে ঝম ঝম কইরা পয়সা রাখত, তালুক ছিল’, বলে তিনি পাটির নিচের কাঠের পাটাতন সরিয়ে একটা গভীর গর্ত দেখান ঘরের মেঝেতে। আমি অবাক হয়ে দেখি।
বড় চাচা আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। জিজ্ঞেস করেন ‘একলা একলা আইতে পারছ’? আমি সোবহান ভাইয়ের কথা বলি। চাচা বললেন, ‘সোবহান লইয়া আইছে? খুব বালা মানুষ’। বৈঠক ঘরের বাঁপাশে, একটি আরবী কুল গাছ বেশ কয়েকটি ডাল বাড়িয়ে দিয়েছে চালের ওপর, বারোমাসি। দাদু কিছু পাকা বরই ধানের ডোলার ভেতর রেখে দিয়েছেন, আশায় আশায় থাকেন আমাদের পথ চেয়ে, তাই তিনি রেখে দেন। আমরা হাজির হলে সেসব বের করে যখন আমাদেরকে দেন, তখন আমাদের খুশি আর ধরেনা। অনেক মাস যায়, যখন কেউ আর আসে না, দাদু খুব মন খারাপ করেন। এইভাবে রেখে দেওয়া আমটা, পেয়ারাটা ডোলা থেকে বের করে বিষণ্ণ হন। আজ বরই বের করে দিয়ে বলেন, ‘পাইক্কা পাইক্কা কত বরই নষ্ট অয়, তরা আছ্, আরও ঘন ঘন আইতারছনা’? দাদুকে বলি, ‘দূর তো, চাইলেই তো আসা যায়না দাদু’! সুযোগ পেয়ে দাদুকে বলি, ‘দাদু আমার সাথে ঢাকা চলেন। আর আব্বাও আপনাকে নিয়ে যেতে বলেছেন’। দাদু উত্তর দেন, ‘আমার লাইগ্যা বুঝি দূর না’!
সন্ধ্যার পর বড় চাচী আর দাদু মিলে পিঠা বানালেন। আমি পরীক্ষায় ভাল করেছি, এই শুনে দাদু বলেন, ‘আইজ তর প্রিয় পিডা বানাইতাম’। আমি জিজ্ঞেস করি ‘মনে আছে কোন পিঠা আমার প্রিয় পিঠা’? দাদু বলেন, ‘মনে আছে, মনে আছে, ছিডা পিডা, আর মশলা পিডা। কিন্তু তুই তো এক দুই কামড় দিয়া কস, আর না আর না; আইজ কিন্তু খাউন লাগব’। বৈঠক ঘরের সামনে একটা বেশ বড় আঙিনা। আঙিনার ওপর তিন দিক থেকে তিনটি সুবৃহৎ আম গাছ, আম ধরেছে ডালে ডালে, তবে এখনও কাঁচা। চাচা চেয়ারে বসে হুক্কা টানছেন, তাঁর সামনে মাচায়, পেছনে পুকুর রেখে, গ্রামের বেশ কএকজন মানুষ বসে আছে। তপ্ত অঙ্গারে তামাক জ্বলছে। হুক্কা, অঙ্গার নিভে যাওয়ার আগেই এ হাত থেকে ও হাতে যায়। চাচা সবাইকে বলেন, ‘আমার ভাইস্তা মেট্রিক পাশ করছে, তোমরা সবাই দোয়া কইরো’। আরও বলেন, ‘মা পিডা বানাইছে,’ তারপর হাঁক দিয়ে বলেন, ‘কইরে পিডা আন, খুশির খবর, সবাইরে দে’। তারপর একজনকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘জাইল্লারে খবর দিস, কাইল সকালে পুস্তে মাছ ধরব’। আমি ভারি পুলকিত হই। আগে আজিমুদ্দিন ভাইয়ের সাথে বিলে গিয়েছি মাছ ধরতে। কাল পুকুরে জাল ফেলা হবে, মাছ ধরা ও দেখার আনন্দই আলাদা। নয়ন সুখকর দৃশ্য। পরেরদিন সকাল সকাল জেলেরা জাল নিয়ে হাজির। পুকুরের দক্ষিণ পাড়ে তিনজন জেলে পানিতে নেমে পূর্ব পশ্চিম আড়া আড়ি জাল ফেলল। তারপর ধীরে ধীরে সমস্ত পুকুর টেনে টেনে, সেই জাল উত্তর পাড়ে এনে, জাল গুটিয়ে ডাঙ্গায় তুলল। মাছ, মাছ আর মাছ, বড় বড় রুই কাতলা লাফাচ্ছে। অসংখ্য ছোট মাছ কিলবিল করছে। আমি এমন দৃশ্য আর দেখি নাই।
পরেরদিন বিকালে ফেরার কথা। বিকালে রওনা হয়ে কিশোরগঞ্জে এক রাত থেকে তবে ঢাকা। কিন্তু ফেরা হল না। দাদুকে ঢাকা যেতে রাজী করিয়েছি। কিন্তু, তিনি অত জলদি যেতে পারবেন না। আমরা আরও দুইদিন পরে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেই। চাচা ছোবহান ভাইকে আগের রাতে খবর দিয়ে রেখেছেন। ছোবহান ভাই সকাল সকাল এসে হাজির। খালে গত দুইদিনে পানি এসেছে। নৌকা এখন বাড়ির পেছন থেকেই পানিতে ভাসানো যাবে। ভাল হল, দাদুকে হেঁটে হেঁটে করমশি বাজারে গিয়ে নৌকায় উঠতে হবেনা। বড়চাচী বড় মায়ার মানুষ, আমার হাতে একটা ব্যাগ দিয়ে বলেন, ‘রাস্তায় ক্ষিদা লাগলে পিডা খাইও, আর কিছু বরই দিছি, খাইও’। দাদুও কয়েকটি পোটলা করেছেন, ছেলের বাড়িতে যাচ্ছেন, খালি হাতে কী করে যাবেন!
ঢাকায় যখন পৌঁছি তখন সন্ধ্যা উৎরে রাত হচ্ছে। বাসায় রাতের খবারের আয়োজন চলছে। আব্বা দাদুকে দেখে আত্মহারা হলেন। মাকে নিয়ে তিনি এই মুহূর্তে কী করে আত্মস্থ হবেন তার কৌশল খুঁজছেন!
Copyright Banglar Kontho ©2024
Design and developed by Md Sajibul Alom Sajon