শীতকাল এলেই দূর দেশের পরিযায়ী পাখিরা আশ্রয়ের জন্য ছুটে আসে মৌলভীবাজারের জুড়ীর হাকালুকি হাওরে। পর্যটক আর প্রকৃতিপ্রেমীরাও তখন হাকালুকি হাওরের সৌন্দর্য দেখতে ভিড় জমান। তবে পরিযায়ী পাখি আসার এই সুযোগ নিয়ে দুর্বৃত্তরা ব্যস্ত হয়ে ওঠে পাখি নিধনে। এ বছর মৌসুমের শুরুতেই সপ্তাহখানেকের ব্যবধানে ফাঁদ পেতে ও বিষটোপ দিয়ে হাওরে শতাধিক পাখি নিধন করা হয়েছে বলে দাবি করছেন স্থানীয় লোকজন। এ পরিস্থিতিতে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া না হলে পাখির এই আবাসস্থল হুমকিতে পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন তাঁরা।
হাকালুকি হাওর মৌলভীবাজারের জুড়ী, কুলাউড়া ও বড়লেখা এবং সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ ও গোলাপগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন এলাকাজুড়ে বিস্তৃত। এর আয়তন প্রায় ২৮ হাজার হেক্টর।
হাওরপারের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শুষ্ক মৌসুমে হাওর শুকিয়ে যায়। এ সময়ে শীতপ্রধান বিভিন্ন দেশ থেকে ছুটে আসা ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি এ হাওরে আশ্রয় নেয়। পাখিরা দিনে দল বেঁধে হাওরের বিভিন্ন বিলে খাবার খুঁজে বেড়ায়। এ সুযোগে দুর্বৃত্তরা জাল দিয়ে ফাঁদ পেতে পাখি নিধন করে। এ ছাড়া সেদ্ধ করা ধানের সঙ্গে এক ধরনের বিষ মিশিয়ে ‘বিষটোপ’ তৈরি করে শিকারিরা বিভিন্ন বিলের পাড়ে ছিটিয়ে দেয়। পাখিরা খাবার ভেবে এসব টোপ খেয়ে মারা যায়। শিকার করা এসব পাখি লুকিয়ে আশপাশের বিভিন্ন হাটবাজার ও বাড়ি বাড়ি ফেরি করে চড়া দামে বিক্রি করা হয়।
স্থানীয় ১০ থেকে ১৫ কৃষক বলেন, গতকাল রোববার সকালে জুড়ী উপজেলার উজান তুরল বিলের পাড়ে ‘বিষটোপ’ দিয়ে শতাধিক পাখি নিধন করেছে শিকারিরা। প্রায়ই ভোরের দিকে মাস্ক পরে আসা কিছু লোক হাওরের বিভিন্ন বিলের পাড়ে ফাঁদ পেতে রাখেন। আবার কেউ বিষটোপ ছিটিয়ে ওত পেতে থাকেন। পাখি শিকারের পর বস্তায় ভরে সটকে পড়েন। শিকারে বাধা দিলে হুমকি-ধামকি ও ভয়ভীতি দেখানো হয় বলে দাবি করেন স্থানীয় কৃষকেরা। এ কাজে জড়িত লোকজনের বাড়ি জুড়ীর বেলাগাঁও, নয়াগ্রাম ও বাছিরপুর এবং পার্শ্ববর্তী বড়লেখা উপজেলার হাওর-সংলগ্ন ভোলারকান্দি ও আজিমগঞ্জ এলাকায়।
গতকাল পাখি নিধনের সঙ্গে জড়িত এক ব্যক্তির পরিচয় পাওয়া গেল কৃষকদের মাধ্যমে। জুড়ীর বাছিরপুর এলাকার হোসেন মিয়া গতকাল পাখি শিকার করেছিলেন। এ ব্যাপারে জানতে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে হোসেন বিষটোপ দিয়ে পাখি শিকারের বিষয়টি স্বীকার করেন। তবে একপর্যায়ে তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন, ‘পাখি মারছি, তো কী হইছে? সমস্যা কী? খাওয়ার জন্য মারছি।’ এ কথা বলেই তিনি সংযোগ কেটে মুঠোফোন নম্বর বন্ধ করে দেন।
এর আগে গত ২৬ নভেম্বর একই উপজেলায় হাওরের গৌড়কুড়ি বিলে ফাঁদ পেতে কয়েকটি পাখি নিধন করা হয়। এ সময় এলাকাবাসীর সহযোগিতায় ১৫টি পাখিসহ দুজন পাখিশিকারিকে আটক করে বন বিভাগের স্থানীয় কর্মকর্তাদের কাছে সোপর্দ করা হয়। পরে লিখিত মুচলেকা দিয়ে শিকারিরা ছাড়া পান।
জানতে চাইলে উপজেলার ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রতন কুমার অধিকারী বলেন, পাখিশিকারিদের কোনোভাবে ছাড় দেওয়া হবে না। পাখি নিধনে জড়িত ব্যক্তির ব্যাপারে খোঁজখবর নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা ও পাখি বিশেষজ্ঞ ইনাম আল হক মুঠোফোনে বলেন, শিকারিদের অপতৎপরতার কারণে হাকালুকি হাওরে পাখির সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। পাখির এই আবাসস্থল নিরাপদ রাখতে হবে। শিকারিদের অপতৎপরতা ঠেকাতে প্রশাসনের পাশাপাশি স্থানীয় লোকজনকেও এগিয়ে আসতে হবে।
Copyright Banglar Kontho ©2022
Design and developed by Md Sajibul Alom Sajon