আন্তর্জাতিক : আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সাধারণ মানুষকে ধরে এনে ব্রাজিলের বাহিয়া রাজ্যে চাষাবাদ করানো হতো। কথা না শুনলে বাহিয়ার রাজধানী সালভাদোরে হাত-পা বেঁধে জনসমক্ষে চলত নির্যাতন। পালানোর পথও ছিল না এই নরক ছেড়ে। তাঁরা শুধু দাঁতে দাঁত চেপে বলতেন, ‘এই কঠোরতার মধ্যেই আমরা জেগে উঠব।’ এভাবে কয়েকশ বছর নির্যাতন সহ্য করার পর সত্যিই তাঁরা জেগে ওঠেন। সেই সঙ্গে সালভাদোরকে তাঁরা গড়ে তুলেছেন ব্রাজিলের ‘সুখের রাজধানী’ হিসেবে।
দেশটির উত্তর-পূর্ব উপকূলের সেরা সমুদ্রসৈকতগুলোর পাশে পরিপাটি শহর সালভাদোরের অবস্থান। এটি আধুনিক ব্রাজিলের জন্মস্থান। ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের শহর সালভাদোরের বাসিন্দারা বলে থাকেন, ‘একটু সময় নিয়ে আকাশের দিকে তাকান, ঈশ্বরের সঙ্গে কথা বলুন এবং (বুঝতে পারবেন) আপনি বাহিয়ায় আছেন।’ খবর বিবিসির
‘সোটেরোপলিটানস’ নামে পরিচিত সালভাদোরের বাসিন্দাদের যদি জিজ্ঞাসা করেন, কোনটি শহরকে আরও প্রাণবন্ত করে তোলে। তাঁরা একটি জিনিসের কথাই বলবেন, সেটি হলো ‘এক্স’। এটি পশ্চিম আফ্রিকার ভাষা ইওরুবার শব্দ। যার অর্থ ‘তেজ’। এই অঞ্চলের অশান্ত ইতিহাসের কথা না বলে সালভাদোরের ‘তেজ’ সম্পর্কে বর্ণনা করা মুশকিল। ১৫৪৯ সালে সালভাদোরে বসতি স্থাপন করেছিল পর্তুগিজরা। ঊনবিংশ শতক পর্যন্ত ব্রাজিলের আফ্রিকান দাস ব্যবসার অন্যতম প্রধান কেন্দ্র ছিল সালভাদোর।
স্থানীয় শিক্ষক ও কবি অ্যান্তোনিও ব্যারেতো বলেন, সালভাদোরের জটিল ইতিহাস বুঝতে শহরের ঐতিহাসিক কেন্দ্রের দেওয়া নাম ‘পেলোরিনহো’ শব্দটি খেয়াল করতে হবে। পর্তুগিজ ঔপনিবেশিক আমলে শহরের কেন্দ্রস্থল ছিল পেলোরিনহো। সেখানে ‘অবাধ্য’ আফ্রিকান দাসদের জনসমক্ষে নির্যাতন করা হতো। সালভাদোরের অন্ধকার সময়ের স্মারক হিসেবে ‘পেলোরিনহো’ নামটি আজও রয়ে গেছে।
আফ্রিকান ক্রীতদাস ও তাঁদের বংশধররা বহু বছর ধরে স্বাধীনতা ও ঐতিহ্যের জন্য লড়াই চালিয়ে গিয়েছিলেন। দীর্ঘ লড়াই শেষে আজ সালভাদোরকে আফ্রো-ব্রাজিলের রাজধানী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাঁরা বর্তমানের ‘তেজ’কে উপভোগ করেন। এ ছাড়া পর্তুগিজ, আফ্রিকান ও আমেরেন্ডিয়ানদের কাছ থেকে নেওয়া সম্পদ ও বাহিয়ান ঐতিহ্যকে গর্বের সঙ্গে উদযাপন করেন। রাস্তায় হাঁটার সময় সহজেই সেখানকার বিচিত্র সংগীত, রান্না ও ধর্মীয় আচারের ঘ্রাণের মিশ্রণ নাকে-চোখে ধরা দেয়।
ব্রাজিলের জনপ্রিয় সংস্কৃতির অংশ ক্যাপোয়েরা। এটি এক ধরনের ব্রাজিলীয় সমরকলা, যাতে নাচ ও সংগীতের অনন্য মিশ্রণ ঘটে। ব্রাজিলে পর্তুগিজদের নিয়ন্ত্রণের ভেতরে আত্মরক্ষার কৌশল হিসেবে আফ্রিকান ক্রীতদাসদের হাত ধরে এই সমরকলা বিকাশ লাভ করে। বর্তমানে ক্যাপোয়েরা বিনোদনের একটি প্রধান অনুষঙ্গ। এটি স্বাধীনতা ও মুক্তির প্রতিনিধিত্ব করে।
টেরেইরো ডি জেসাসের আশপাশে সাম্বা নাচ দেখা যায়। সাম্বার শিল্পীরা গিটার, ড্রাম ও খঞ্জনির তালে তালে নাচেন। ক্যাপোয়েরার মতো সাম্বা নাচও বাহিয়ায় দাসত্ব করা আফ্রিকানদের হাত ধরে জন্ম নিয়েছিল, যাকে এখন ব্রাজিলের জাতীয় নাচ বলে বিবেচনা করা হয়। উপনিবেশ যুগে ব্রাজিলজুড়ে সাম্বার বিভিন্ন রূপ বিকাশ লাভ করে।
সালভাদোরে খাবার যেন উদযাপনের একটি আবশ্যিক উপাদান। সেখানকার জনপ্রিয় খাবার ‘আকারাজ’। এটি এক ধরনের স্ট্রিট ফুড, যা কলাপাতায় ভাপানো হয়। এই খাবার বার্ষিক আচার-অনুষ্ঠানের সময় উপাসকদের মাধ্যমে ক্যান্ডম্বলের দেবতা অরিক্সাসকে উৎসর্গ করা হয়ে থাকে।
সালভাদোরের বাসিন্দাদের জিজ্ঞাসা করলে ঝটপট বলে দেবেন, তাঁরা অন্যান্য ব্রাজিলিয়ানদের তুলনায় অনেক বেশি সুখী। কারণ, অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় তাঁদের এখানে উৎসব বেশি হয়। তবে সালভাদোরের সুখের আসল চাবিকাঠি সম্ভবত তার অস্থির ইতিহাসকে অনন্য সুখে রূপান্তর করার ক্ষমতার মধ্যে নিহিত। ব্রাজিলকে এই সুখ যুগ যুগ ধরে দিয়ে যাচ্ছে শহরটি।
Copyright Banglar Kontho ©2022
Design and developed by Md Sajibul Alom Sajon